শৈশবঃ ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো (পর্ব-দুই)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:৩৭:৪৯ সকাল
স্মৃতিতে দাদা বাড়িঃ
আমার ছেলেবেলায় বেশীরভাগ সময়ই নানা বাড়িতে কেটেছে। তবে দাদা বাড়িতেও অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। নানা বাড়ি থেকে সেই সময়ে দাদা বাড়ি যাতায়াতের বেশ ঝক্কি ছিল। তখনকার বাসগুলো ছিল মুড়ির টিনের' মত। এগুলোকে স্টার্ট দিতে এক ধরণের লম্বা হ্যান্ডেল ব্যবহার করতে হত, যেটি বাসের বাহির দিয়ে একেবারে সামনের একটি ছিদ্রতে ঢুকিয়ে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরালেই তবে স্টার্ট হত। আর যাতায়াতের অনেকটা পথ নৌকায় করে বিষখালি নদী দিয়ে যেতে হত। আব্বা আমার ছেলে বেলায় একটি লোহার চেয়ার তৈরী করিয়েছিলেন, নৌকার দুলুনিতে যাতে আমি ভারসাম্যহীন হয়ে না পড়ি, তাই সেই চেয়ারে বসিয়ে আমাকে একটি বেল্টের সাথে আটকে রাখতেন। আজ ৪৩ বছর ধরে সেই চেয়ারটি আমার কাছে সযতনে রয়েছে!
[ ৪৩ বছরের পুরনো সেই চেয়ারটি]
দাদাকে আমার আম্মাও দেখেন নাই। আর দাদীর স্মৃতি খুব অল্পই মনে আছে আমার। আমরা দাদা বাড়ি গেলে তিনি আমার এক চাচাকে পুকুর থেকে খেজুর এর ছড়া তুলে এনে আমাকে দিতে বলতেন। গাছ থেকে খেজুর ছড়া সহ কেটে পাকাবার জন্য পুকুরে ভিজিয়ে রাখা হত। আর আজ কার্বাইডের বিষাক্ত ছোবলে কোনো ফলই খাবার উপায় নেই। দাদীর কথা আমার এটুকুনই মনে আছে।
আমার প্রথম দুর্ঘটনাঃ
তখন গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলনা। ছিল হারিকেন আর কেরোসিন কুপি যাকে আমরা ল্যাম (আসলে হবে ল্যাম্প) বলতাম। যে কোনো অনুষ্ঠানের সময় হ্যাজাক বাতি ব্যবহার করা হত। এই ল্যামের সলতের পোড়া অংশ কিছুটা স্ফীতাকারে দলা হয়ে থাকত। এগুলোকে আমরা ছোটরা বলতাম ফুল। আমরা এই ফুল খেতাম। একদিন আব্বার এক দূর সম্পর্কের ভাই, মেনহাজ নাম ছিল ওনার, তিনি দাদা বাড়ি অবস্থানের সময় আমার দেখাশোনা করতেন; তিনি বললেন, ' এই ফুল না খাইয়া কেরোসিন খা'। তিনি আসলে রসিকতা করে বলেছিলেন। কিন্তু শিশুদের সাথে এমন কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করাটা যে কতটা বিপদজনক, তিনি সেদিন সেটি বুঝেছিলেন। আজ ভাসা ভাসা মনে পড়ে, তার কথামত ল্যামের ভিতরের সবটুকু কেরোসিন আমি খেয়ে ফেলেছিলাম। এরপরের ঘটনা অনেক উদ্বেগজনক ছিল। সেই সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামে আশেপাশে কেন, বহুদূর পর্যন্ত কোনো ডাক্তার ছিল না। মুরব্বিদের হাতুড়ে চিকিৎসায় আর পরম করুনাময়ের অশেষ রহমতে আমি সুস্থ হতে পেরেছিলাম।
আর একটি স্মৃতি মনের মুকুরে দোলা দিয়ে যায়। তখন দেশীয় প্রজাতির মাছে হাওড়,খাল-বিল সয়লাব ছিল। সেগুলোর স্বাদ যেমন ছিল, তাদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বর্ষা মওসুমে দাদা বাড়ির সামনের ধানি জমিগুলো বিলে পরিণত হত। তখন সেখানে হরেকপদের মাছে টিটুম্বর করত। আমার আরো এক চাচার নাম ছিল 'চান মিয়া'। আমরা ডাকতাম চান্দু কাক্কু বলে। তিনি আমাকে নিয়ে নৌকায় করে সেই বিলে কই মাছ ধরতে যেতেন। যাবার সময় আম্মা বড়শিতে দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে দিতেন, যাতে বেশী বেশী মাছ ধরা পড়ে।
নগরজীবনে প্রবেশঃ
আব্বার পোষ্টিং তখন ছিল খুলনায়। তিনি আমাদেরকে সেখানে নিয়ে এলেন। আমার আর একটি ভাই তখন পৃথিবীতে এসেছে। মাছুম, আমি আর আবা-আম্মা- এই চারজনের নগরজীবন শুরু হল। তখন তো আর নগরজীবন এতো জটিল এবং সবুজবিহীন কংক্রিটের হয়ে উঠেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল তখন। আমরা খুলনার খালিশপুরের এক ভাড়া বাসায় উঠে এলাম।
এখানেই আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর দেখা পেলাম।
সে একজন মেয়ে ছিল। রুপা তার নাম। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, তার ঠিক সামনেই ছিল ওদের বাড়ি।সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি। আর আমরা থাকতাম একটি টিনশেডের ভাড়া বাসায়।সেখানে আরো দুটি পরিবারও থাকতো। তো এহেন সামাজিক মর্যাদার বিস্তর ব্যবধান স্বত্বেও আমি আর রুপা বন্ধু হয়েছিলাম। বিকেলে রুপার ভাই এবং তার অন্য বন্ধুদের সাথে আমিও খেলতে যেতাম। রাবারের টেনিশ বল দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা খেলতাম। আর যখনই বলটি ড্রেনে পরে যেত, রুপার ভাই মুন্না আমাকেই বলটি তুলে আনতে বলত। আমি যে ছিলাম সেই সময়ে সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে সব থেকে নিচুতে। আমি তুলে আনতাম, আর মনে মনে ভাবতাম, সব সময় আমাকেই কেন তুলে আনতে বলে? রুপা কষ্ট পেত। একদিন সে সরাসরি বলেই ফেলল, তুই আর বল তুলে আনবি না।' সেই ছেলেবেলায়ই শ্রেণী বৈষম্য আমার চেতন মনে না বুঝেই ধরা দিয়েছিল... আর রুপাই আমাকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল। জানি না আজ এই বন্ধুটি কোথায় আছে, কেমন আছে!
এখানে বেশ বড় একটি দিঘী ছিল। অনেক দূর পর্যন্ত তার শান বাঁধানো ঘাটলা পানির গভীরে নেমে গেছে। আমি বিকেল বেলা অন্যদের সাথে ঝাপাঝাপি করতাম। আম্মা ছোট ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার খোঁজখবর তেমন নিতে পারতেন না। আব্বা পাঁচটায় অফিস থেকে এসেই আমাকে না পেয়ে পুকুরে চলে যেতেন। অফিসের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। আমাকে পুকুর থেকে ধরে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমার চোখ লাল হয়ে থাকতো। এটা দেখে আব্বা প্রচন্ড রাগ হতেন। আমাকে 'মাইরও' দিতেন বেশ করে। তারপরও প্রতিদিন একই সময়ে পুকুরে না ডুবালে কেন জানি শান্তি পেতাম না। আর আব্বার সামনে যাতে লাল চোখ নিয়ে যেতে না হয়, সেজন্য জলকেলির এক পর্যায়ে দুহাতে পানি নিয়ে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করতাম, ' লাল না সাদা?' অপরজন সব সময় সাদা-ই বলত। আর পরক্ষণেই সেই 'সাদা পানি' দিয়ে নিজের চোখে ঝাপটা দিতাম। আর মুহুর্তেই চোখ সাদা হয়ে যেত। আমাদের কচি হৃদয়ে সেই সময়ে এমনটি-ই আমরা ভাবতুম। কিন্তু তারপরও কেন যেন চোখ লাল এর জন্য আব্বার 'মাইর' থেকে রক্ষা পেতাম না।
এখান থেকে বাসা বদল করে আমরা খুলনার রায়ের মহলে চলে এলাম। এখানে এসে আমার দুরন্তপনা আরো বেগবান হয়েছিল। কলা পাতাকে ঘোড়ার কেশরের মত দু'পাশে ছিড়ে বানিয়ে সেটিকে ঘোড়ায় পরিণত করে তাতে চড়ে দিনভর রায়েরমহলের মাটির রাস্তায় দৌড়ে বেড়াতাম। এখানে এই এলাকায় তখন ঘোড়া দিয়ে মালামাল টানার কাজটি করা হত। গরুর গাড়ির বদলে ঘোড়ার গাড়ির বহুল ব্যবহার ছিল। ঐ সময়টিতে আমি নিজেকে একটি ঘোড়া ভাবতাম।
আমার আনুষ্ঠানিক প্রথম স্কুল ছিল এইখানে। রায়েরমহল প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে আব্বা আমাকে একদিন ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য সুখকর ছিল না। একজন মহিলা টিচার ক্লাশ নিতে এলেন। অন্য সকলকে পড়া জিজ্ঞেস করলেন, সাথে আমাকেও। আমার আজ প্রথম দিন! কিভাবে পারব? কিন্তু তিনি অন্য সবার সাথে আমাকেও কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। পরের পিরিয়ডে সোজা বাসায় চলে এলাম। আর গেলাম না ঐ স্কুলে। সেই ছিল আমার একদিনের জীবনের প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। সব শুনে আব্বাও আর ওখানে যেতে জোর করলেন না।
গত কোরবানির ঈদে আমার মেয়েদেরকে নিয়ে সেই স্কুলটি দেখিয়ে এনেছি। সেদিন এতোগুলো বছর পরে যখন স্কুলের সামনে গেলাম, পুরনো সেই মুহুর্তগুলো কেন জানি এক অন্য আবেশে আমাকে আন্দোলিত করছিল...সেদিনের সেই বিব্রত মুহুর্তটি কেন জানি এক অনাবিল সুখের উচ্ছ্বাসে নিজেকে প্রগলভ করে তুলল। এক টুকরো অতীত যেন অন্ধকার ফুঁড়ে সহস্র সূর্যের আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে মনের গহীনে সেই সুরটি-ই বাজিয়ে তুলল-
'পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়...'
(আগামি পর্বে সমাপ্য)
বিষয়: সাহিত্য
১২০৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্কুল এর সেই শিক্ষিকা আপনাকে আগে না দেখেও পড়া ধরেছিলেন। সত্যিই এ ধরনের কিছু শিক্ষক এর জন্য অনেক শিশুই বাল্যকালিন ট্রমাতে আক্রান্ত হয়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, শুভেচ্ছা রইলো।
শুভেচ্ছা রইলো।
একটি সরল মনই আর একটি সরল মনকে চিনতে পারে।
আপনার শুভ কামনা পৌঁছে দিলাম।
আপনার জন্যও নিরন্তর শুভ কামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
শৈশবে আমি সিনিয়র বন্ধুদের উস্কানিতে গাছ থেকে ছিড়ে ধাউন্না মরিচ(ছোট ছোট কাঁচা মরিচ) চিবিয়ে খেয়ে বিপদে পড়েছিলাম।
হ্যা, ধাইন্না মরিচ চিনি। যে ঝাল!
হ্যা, সেই সময়ে আমাদের মন এতটা ফ্রেশ ছিল যে, যে কোন কিছুই সহজে বিশ্বাস করে নিতাম।
এখন ভাবি, কোথায় যে সেই মন?
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
ইস মাঝে মাঝে ভাবি গল্পের টাইম মেশিন যদি আমার থাকতো বার বার আমি আমার শৈশবে ফিরে যেতাম। আর এ পর্যন্ত করা ভুল গুলো শুধরাইতাম।
আমার মেইলের উত্তর পেয়েছিলেন কিনা জানাবেন।
প্রসঙ্গটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। একটা প্লট দাঁড়া করিয়েছি মনে মনে। আপনার সাহায্য লাগবে।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
যদিও গল্পের শেষ অংশ টুকু আমি বলিনি কারন কেন যেন মনে হচ্ছে বিতরকিত হয়ে যাবে। আর আপনার প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থা আছে সেই সাথে লিখার প্রতি। কিভাবে পেয়েছি প্রশ্ন করবেন না। ব্লগিও ভালবাসা বা সন্মান যা আপনার জন্য আমার মনে যেখানে যতটুকু রেখেছি সেখান থেকে এক চুল কমবেনা এবং নড়বে না।
আপনি প্রকাশ করুন। প্রয়জনে আমি মেইলে আপনাকে বাকি কথা বলবো।
আমি ভাবনা-চিন্তার পর্যায় শেষ হলেই লিখাটি পোষ্ট করা শুরু করব।
ধন্যবাদ আপনাকে। জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন